আল্লামা ইকবালের জীবনী,দর্শণ- Life of Allama Iqbal

মুহাম্মদ ইকবাল- Mohammad Iqbal 

আল্লামা ইকবালের আসল জীবনী

মুহাম্মদ ইকবালের জীবনী-  The life of Mohammad Iqbal



 প্রাককথনঃ

 বিংশ শতাব্দীর মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে মুহাম্মদ ইকবালের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পাক-ভারত-বাংলাদেশ উপমহাদেশে মুসলিম সমাজের পাশ্চাত্য জ্ঞান- বিজ্ঞান শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে নিস্পৃহ মনমানসিকতার ক্ষতিকর পরিণাম উপলব্ধি করে তিনি মুসলিম জনমানসে নতুন চেতনা ও আধুনিক মনমানসিকতা সৃষ্টি করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। মুহাম্মদ ইকবাল মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে তাঁর পূর্বসূরি শাহ ওয়ালিয়ুল্লাহ, সাইয়েদ আহমদ খান ও সাইয়েদ আমীর আলীর পথকে অনুসরণ করে এটা উপলব্ধি করতে পারেন যে, এ উপমহাদেশের মুসলিম জনমানসে পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্বারা প্রচারিত ও প্রসারিত নব্য শিক্ষার প্রতি অদ্ধবিদ্বেষী মনোভাব দূর করে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষায় শিক্ষিত হতে মুসলিম সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে না পারলে মুসলমানদের দৈন্য ও দূর্দশা দূর হবে না এবং তাদের হৃত গৌরব ফিরে পাওয়া কোন অংশে সম্ভব হবে না। তিনি প্রথমে ধর্ম হিসেবে ইসলামের মূল বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন এবং বলেন যে, ধর্ম হিসেবে ইসলাম নিছক অনুভূতি ও যুক্তিহীন বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, বরং ইসলামের বুনিয়াদ যৌক্তিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলামের বুদ্ধি- বৃত্তিক ভিত্তি সুদৃঢ় বলেই চিন্তার তথা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইসলামের অবদান আজ সুবিদিত। ইসলাম এমন একটি ধর্ম, যা জগত ও জীবনের সার্বিক সমীক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত ও যা জীবনের একটি পূর্ণাঙ্গ বিধানস্বরূপ। তিনি ইসলামের শিক্ষাসমূহকে আধুনিক চিন্তার সঙ্গে সমন্বিত করতে একদিকে কুরআন, হাদীস ও জালালুদ্দীন রূমীর দর্শন এবং অপরদিকে উইলিয়াম জেমস্, নীটশে, বার্গসোঁ ও ম্যাকটেগার্টের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ইকবাল পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন সব দিককে গ্রহণ করার পক্ষপাতী ছিলেন, যেগুলো ইসলামের মর্মবাণীর পরিপন্থী নয়। প্রকৃতির রহস্যের আবরণ উন্মোচন, প্রাকৃতিক নিয়মাবলি আবিষ্কার ও মানুষের কল্যাণে সদ্ব্যবহার করার জন্য মুসলিম দর্শন ধর্মতত্ত্ব ও সংস্কৃতি পুনরিসের কুরআনে যে বারবার বলা হয়েছে, সে সম্পর্কে তিনি মুসলিম সমাজকে সচেতন করে তোলার প্রচেষ্টা চালান। মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে জীবনের নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খেয়ে চলার পথে ইসলামের ধর্মীয় চিন্তার সংস্কার ও উপর তিনিও তাঁর এ উপমহাদেশের পূর্বসূরিদের মতো গুরুত্ব আরোপ করেন। আর ও ধরনের পুনর্গঠনের যৌক্তিকতা প্রদর্শনের জন্য তিনি শাহ ওয়ালিয়ুল্লাহর মতো ইজতিহাদ নীতির সমর্থন করেন। তিনি মনে করেন যে, নতুন নতুন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চলার পথে ইসলামী আইনের উৎস হিসেবে কুরআন ও হাদীসের পরে ইজতিহাদ নীতির বান এবং এই ইজতিহাদ নীতির সাহায্যেই আইনের ক্ষেত্রে ইসলামের অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। তিনি ইজতিহাদের কতকগুলো মৌলিক সূত্রের উল্লেখ করে ব্যবহারিক জীবনে তাদের আলোকে সিদ্ধান্ত নেয়ার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। ইসলাম ধর্মের কাঠামোর মধ্য দিয়েই ইকবালের চিন্তা-চেতনা গড়ে উঠে। তিনি বলেন যে, ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা কেবল পারলৌকিক জীবনের সম্ভাবনার কথা বলে না, ইহলৌকিক জীবনের আর্থ-সামাজিক সুব্যবস্থা ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার কথাও বলে। ইসলাম মানুষের জন্য একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা।

আল্লামা ইকবালের জন্ম এবং বংশ পরিচয়ঃ 

মুহাম্মদ ইকবাল পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে ১২৮৯ হিজরী/১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন সাগু বর্ণের কাশ্মীরী ব্রাহ্মণ। তাঁর পিতার নাম ছিল নূর মুহাম্মদ। তাঁর পিতা ছিলেন ধর্মপরায়ণ মানুষ, যাঁর কাছে ধর্ম একটা জীবন্ত অভিজ্ঞতার বিষয় বলে পরিগণিত হতো। ইসলামী মরমীবাদের প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ আকর্ষণ। 

 

আল্লামা ইকবালের বাল্যকাল এবং শিক্ষাজীবনঃ

 ইকবালের প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শিয়ালকোটে শুরু হয়। বাল্যকাল থেকেই তাঁর মধ্যে তীক্ষ্ণ প্রতিভার স্ফুরণ দেখতে পাওয়া যায়। এ সময় তিনি মীর হাসান নামক একজন প্রখ্যাত শিক্ষক ও পণ্ডিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসেন। ইকবালের বুদ্ধিমত্তা ও শিক্ষার প্রতি গভীর আগ্রহ দেখে মীর হাসান ইকবালের পিতাকে গ্রেট ব্রিটেনের বেতনগ্রাহী বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা হয় এমন শিক্ষালয়ে ভর্তি করার জন্য অনুরোধ করেন এবং তিনি তাঁর এ অনুরোধে সাড়া দেন ও তাঁকে সে স্কুলে ভর্তি করান। এই স্কুলে বৃটিশ ভারতীয় শিক্ষা পদ্ধতি অনুযায়ী পাঠ্যক্রম ও শিক্ষা পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। ইকবাল যে স্কুলে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন, সেই স্কুলে মীর হাসান শিক্ষকতা না করলেও নীর হাসানের পান্ডিত্যের প্রভাব ইকবালের শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রবলভাবে পড়ে।

আল্লামা ইকবালের  উচ্চ শিক্ষা:

 আল্লামা ইকবাল  উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে লাহোরে গমন করেন এবং লাহোর সরকারি কলেজে ভর্তি হন। পরে তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে দর্শন বিষয়ে এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন। এই সময়ে তাঁর শিক্ষক ছিলেন প্রাচ্যবিদ্যাবিশারদ থমাস আর্নল্ড। এভাবে তিনি একদিকে মীর হাসানের প্রভাবে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতি অনুপ্রাণিত হন এবং অপরদিকে থমাস আর্নল্ডের প্রভাবে পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রতি আকৃষ্ট হন। পরবর্তীতে ১৯০৫ সনে ইকবাল পাশ্চাত্য দর্শনে উচ্চতর শিক্ষালাভের উদ্দেশ্য ইংল্যান্ডে যান এবং সেখানে আর্নল্ডের সাথে পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন করেন। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাকটেগার্টের তত্ত্বাবধানে পাশ্চাত্য দর্শন সম্পর্কে উচ্চতর আন ও ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি জার্মানের মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'দি ডেভেলপমেন্ট অব মেটাফিজিকস্ ইন পারসিয়া' নামে খ্যাত তাঁর 'থিসিস' লিখে পি-এইচ. ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। এ সময় তিনি ব্যারিস্টারী পাশ করেন এবং কিছুকাল লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেন। 

আল্লামা ইকবালের কর্মজীবনঃ 

 লন্ডনে পি-এইচ. ডি. ডিগ্রি লাভ করার পরে এ সময় তিনি ব্যারিস্টারী পাশ করেন এবং কিছুকাল লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেন। এর পর তিনি কর্মজীবনে লাহোর সরকারি কলেজে কিছুদিন অধ্যাপনার করেন এবং এরপর সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে আইন ব্যবসা-সহ ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। 

আল্লামা ইকবালের রচনাসমূহঃ

 ইকবাল প্রথমে ফার্সী ভাষায় লিখিত কবিতার মাধ্যমে দর্শন চর্চা শুরু করেন বলে মনে করা হয়। তাঁর লিখিত গ্রন্থের মধ্যে 
  • 'আসরার-এ-খুদী',
  • 'রুমূয়ে বে-খুদী', 
  • 'পয়াম-এ মাশরিক',
  •  'জবুর-এ-আযম',
  •  'জাবিদনামা' 
ফার্সী কাব্য গ্রন্থের মধ্যে প্রসিদ্ধ।
 উর্দু ভাষায় তিনিই প্রথম অর্থনীতির ওপর বই লেখেন। তাঁর উর্দু কাব্য গ্রন্থের মধ্যে
  •  "বাল-এ-জিব্রাঈল'
  •  ও 'জাবর-এ-তালিম' উল্লেখযোগ্য।
 ইংরেজি ভাষায় লিখিত "দি রিকনস্ট্রাকশন অব রিলিজিয়াস এট ইন ইসলাম' গ্রন্থটি বক্তৃতামালার গ্রন্থনা। এই গ্রন্থে তাঁর দার্শনিক প্রজ্ঞা, অগাধ পান্ডিত্য ও মৌলিকতার ছাপ মেলে। ইসলামের দার্শনিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এ গ্রন্থ মৌলিক অবদান রাখে। তাঁর "দি ডেভেলপমেন্ট অব মেটাফিজিকস্ ইন পারসিয়া' গ্রন্থটিতে তার দার্শনিক চিন্তাধারা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। 

আল্লামা ইকবালের মৃত্যুঃ

 আল্লাহ্ ইকবাল ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে লাহোরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

 আল্লামা ইকবালের দার্শনিক অবদান এবং প্রভাবঃ


 সাহিত্য, দর্শন ও সংস্কৃতির উপর ইকবালের গভীর পান্ডিত্য ছিল এবং তিনি 'আল্লামা ইকবাল বলে সুপরিচিত হন। ইসলামী ও প্রাচ্য চিন্তাধারার সাথে পাশ্চাত্য সাহিত্য, দর্শন ও সংস্কৃতির কল্যাণকর দিকের সমন্বয় সাধনের তিনি প্রচেষ্টা চালান। ধর্ম, দর্শন, কলা, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, জাতীয়তাবাদ, মুসলিম জীবনের পুনঃপ্রবর্তন, বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রভৃতি বিষয়ের প্রতি তাঁর রচনাকর্ম বিস্তৃত ছিল। আরবী, ফার্সী, উর্দু, জার্মান ও ইংরেজি ভাষার উপর তাঁর দখল অসাধারণ ছিল। তিনি দার্শনিক ও কবি হওয়া সত্ত্বেও বাস্তব ও সমকালীন জীবনের সঙ্গে জড়িত বিষয়াবলি সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। এ উপমহাদেশের রাজনীতিতে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তিনি ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবে ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে জনসাধারণের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ইকবাল ১৩২৭ হিজরী/১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে প্রাচ্যও নয়, প্রতীচ্যও নয় এমন এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দর্শন ও সংস্কৃতি গভীরভাবে অধ্যয়ন করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, পাশ্চাত্যের একমুখো জড়বাদী মনোভাব যেমন একদিকে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক নয়। অপরদিকে তেমনি প্রাচ্যের কর্মহীন অলস ও বাস্তব জীবন বিমুখী আধ্যাত্মিক মনোভাব সারহীন ও নিষ্প্রাণ। তিনি তাঁর রচনাকর্মে এই দুই বিপরীতধর্মী মনোভাবের সমন্বয় সাধন করে মানুষের কল্যাণের দিক নির্দেশনা দেন। ইকবালের কাব্যিক ও দার্শনিক চিন্তাধারা জীবন বিচ্ছিন্ন কোন আকাশকুসুম কল্পনা নয়, বরং বাস্তবধর্মী, যেখানে মানুষের মধ্যে অবস্থিত সুপ্ত সীমাহীন সম্ভাবনাকে মানুষের আত্মবিকাশের জন্য বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। মানুষ আল্লাহ্র প্রতিনিধি। মানুষ তাঁর খুদী বা আত্মসত্তার পূর্ণবিকাশের মাধ্যমে ইনসানে কামেল বা মর্দে মুমিন-এ উন্নত হতে পারে। তিনি জীবনবিমুখতা ও নিষ্ক্রিয়তা থেকে মুক্ত হয়ে সক্রিয়তা ও জীবনমুখী কর্মে নিয়োজিত থাকার জন্য মানুষকে আহবান করেছেন। ইকবালের দর্শন পর্যালোচনা করলে আমরা এর মধ্যে সাধারণত চারটি মৌলিক ধারণার সাক্ষাৎ পাই : ১. স্বজ্ঞা; ২. খুদী বা আত্মসত্তা, ৩. জগগ তাঁর দর্শন ত্বত্ত্ব

 আল্লামা ইকবালের স্বজ্ঞা- Intuition ত্বত্বের বিশ্লেষনঃ


 জ্ঞানের উৎস হিসেবে অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি ও যজ্ঞা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে আমরা জ্ঞানবিষয়ক মতবাদে অভিজ্ঞতাবাদ, বুদ্ধিবাদ ও স্বজ্ঞাবাদ নামে তিনটি প্রধান মতবাদ দেখতে পাই। ইকবাল এসব মতের কোন একটির একক সমর্থক নন; তবে তিনি স্বজ্ঞার প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল ছিলেন। কেননা ইকবাল এটা দেখানোর প্রচেষ্টা চালান যে, বাস্তব সত্তার সব দিক সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য এগুলোর প্রত্যেকটিই কোন-না-কোন পর্যায়ে আবশ্যক হয়ে পড়ে। 

এ প্রসঙ্গে বলা যায়, পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানের জন্য তিনি ধর্মীয় প্রত্যাদেশের প্রয়োজনীয়তাকেও স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, যে বুদ্ধিবাদ মূর্ত বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, সে বুদ্ধিবাদ ঐশী বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে সঠিক বুদ্ধি ও যথার্থ ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। তিনি বুদ্ধিবাদের সমর্থন করতে গিয়ে জ্ঞানের ক্ষেত্রে যথার্থ অভিজ্ঞতার ভূমিকাকে অস্বীকার না করে বলেন যে, অভিজ্ঞতা বিবর্জিত নিছক বুদ্ধির চুলচেরা বিশ্লেষণ কেবল অর্থহীন নয়, বরং বিপজ্জনকও বটে। তিনি গ্রীক বুদ্ধিবাদী ও মু'তাযিলাদের দর্শনের পর্যালোচনা করে এটা দেখানোর প্রয়াস পান যে, জ্ঞানের পূর্ণাঙ্গ রূপের সাক্ষাৎ লাভের জন্য অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি ও যজ্ঞা পরস্পর বিরোধী নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক। তিনি গ্রীক বুদ্ধিবাদীদের অনুসারী মুসলিম দার্শনিকদের মতবাদকে খন্ডন করে পরম সত্তার জ্ঞান লাভের জন্য মরমী অভিজ্ঞতা বা স্বজ্ঞাকে স্বীকার করার জন্য আল-গাযালীর মতের সমর্থন করেন। তবে এক্ষেত্রে তিনি বুদ্ধি ও স্বজ্ঞার সম্পর্কের ব্যাপারে আল- গাযালীর মতকে স্বীকার করেননি। ইমানুয়েল কান্ট বুদ্ধির স্বরূপ যৌত্ত্বিকভাবে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাঁর 'দি ক্রিটিক অব পিওর রিজন' গ্রন্থে প্রথমে দেখান যে, জ্ঞানের উৎস হিসেবে বুদ্ধির 'ক্যাটিগরিগুলো' (categoris) কেবল পরিদৃশ্যমান জগতের মধ্যে সীমিত থাকে বলে তত্ত্ববিদ্যা বা অধিবিদ্যা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তবে তিনি পরবর্তীতে তাঁর "দি ক্রিটিক অব প্র্যাকটিক্যাল রিজন' গ্রন্থে এটা দেখান যে, বুদ্ধির ক্যাটিগরিগুলো সীমিত পরিসরে আবদ্ধ থাকে না, বরং এসব ক্যাটিগরির ঊর্ধ্বে অবস্থিত অধিবিদ্যার সম্ভাব্যতার নির্দেশ করে, যেখানে ঈশ্বর, ইচ্ছার স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয়ের আলোচনা করা হয়ে থাকে। তবে আনের ক্ষেত্রের বুদ্ধির ক্যাটিগরিগুলোর এ সীমাবদ্ধতা সম্মন্ধে কান্টের বহু আগেই রূমী উপলব্ধি করেছিলেন। কান্ট যাকে 'বুদ্ধি' (intellect) বলে আখ্যায়িত করেছিলেন, রূমী সেটাকে 'বিশেষ বুদ্ধি' (particular reason) বলে আখ্যায়িত করেন। এবং সার্বিক বুদ্ধি-কে (universal reason) পরম সত্তার স্বজ্ঞার অর্থে গ্রহণ করেছিলেন। রূমীর মতের প্রভাব ইকবালের উপর পড়েছিল। ইকবাল মনে করেন যে, যুক্তিপ্রসূত বুদ্ধি এমন কিছু পরস্পর অসঙ্গতিপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের নির্দেশ করে, যার ফলে এটি যুক্তিপ্রসূত বহুত্বের মধ্যে ঐক্যের সন্ধান দিতে পারে না; ফলে জগতের সামগ্রিক ঐক্য ও সংহতি খুঁজে পাওয়া যায় না। আসলে মানবীয় বুদ্ধি নিছক কোন খন্ড বুদ্ধির পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ নয় বলে কেবল যৌক্তিক বিচার-বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মধ্যে এর সকল শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায় না। বরং চিন্তা গভীরতর গতির মধ্য দিয়ে এ এমন এক অন্তর্বর্তী অসীমের সন্ধান পায়, যার আত্মপ্রকাশের গতিকে বিভিন্ন সসীম ধারণার বিন্দু বা মুহূর্ত বলা যায়। আর তাই জ্ঞানের গতিতে একটি সমগ্র অসীমের উপস্থিতিই সসীম চিন্তাকে সম্ভব তোলে। চিন্তা সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন কোন কিছু নয়, বরং এরা একে অপরের সঙ্গে পারস্পরিক সম্বন্ধে যুক্ত। আদর্শ ও বাস্তবের মধ্যে ধারাবাহিকতা বিদ্যমান রয়েছে বলে বাস্তবের সঙ্গে বৈষম্যে নয়, বরং আঙ্গিক যোগাযোগের মধ্যেই নিহিত রয়েছে আদর্শ জীবন। ইকবাল দেশ-কাল উর্দ্ধ আন্তর সত্তা (noumena) সম্পর্কে ভিন্ন মত প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, পরিদৃশ্যমান জগতের মানবীয় জ্ঞানের আত্মগত আকার হিসেবে দেশ ও কাল তাৎপর্যের দিক থেকে নিশ্চল ও নিয়ন্ত্রিত নয়, যার মনস্তাত্ত্বিক শক্তির হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে অর্থেরও পরিবর্তন হয়। আর এভাবে মনোবিকাশের উচ্চতম স্তরে এমন এক অস্তিত্বের স্তর রয়েছে, যা দেশ-কাল নির্ভর অভিজ্ঞতার স্তরের উর্ধ্বে। এই স্তরকেই ‘স্বজ্ঞা' বলা হয়। দেশ ও কালের আকারের ঊর্ধ্বে অবস্থিত বলে স্বজ্ঞামূলক অভিজ্ঞতার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যজ্ঞামূলক অভিজ্ঞতা অসীমিত (অদৈশিক) ও অপরিবর্তনীয় (অকালিক)। 

সজ্ঞামূলক অনুভূতির বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো। 

 প্রথমত, স্বজ্ঞা পরম সত্তা সম্পর্কে অব্যবহিত ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। স্বজ্ঞাপ্রসূত জ্ঞান বুদ্ধিপ্রসূত জ্ঞান থেকে পৃথক, কেননা বুদ্ধিপ্রসূত জ্ঞান পরোক্ষ ও অপর কোন কিছুর মাধ্যমে প্রাপ্ত। স্বজ্ঞাপ্রসূত জ্ঞান অভিজ্ঞতাপ্রসূত জ্ঞান থেকে পৃথক, কেননা অভিজ্ঞতাপ্রসূত জ্ঞান খণ্ডধর্মী। অভিজ্ঞতাপ্রসূত জ্ঞান সত্তার আংশিক ও অসম্পূর্ণ জ্ঞান। পক্ষান্তরে, যজ্ঞাপ্রসূত জ্ঞান সমগ্রকে উপলব্ধি করে, অর্থাৎ এ সমগ্র সত্তার প্রত্যক্ষ উপলব্ধি। স্বজ্ঞাপ্রসূত জ্ঞানে সত্তার ধারণা আমাদের কাছে সরাসরি ধরা দেয়।

 দ্বিতীয়ত, যজ্ঞা হৃদয়ের এক বিশেষ উপলক্ষণ (property) বা গুণ হওয়ায় এমন বা বুদ্ধির কোন উপলক্ষণ নয়। মন কেবল পরিদৃশ্যমান জগতকে জানতে পারে, হৃদয় পরম সত্তার এমন দিকের সঙ্গে আমাদের সরাসরি পরিচয় করিয়ে দেয়, যা ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণের আওতাভুক্ত নয়। চিন্তা বা বুদ্ধিতে কেবল জ্ঞানের ক্যাটিগরিগুলোর মাধ্যমে পরিদৃশ্যমান বস্তুকে জানা যায়। এভাবে বুদ্ধিপ্রসূত জ্ঞানের মাধ্যমে বস্তুর অবভাসকে জানা যায়, বস্তুর আসল রূপকে জানা যায় না। কিন্তু স্বজ্ঞার ক্ষেত্রে আমরা প্রত্যক্ষ অনুভূতির মাধ্যমে বস্তুর আসল রূপ জানতে পারি। স্বজ্ঞাপ্রসূত জ্ঞান অনুভূতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে বলে এ জ্ঞান মূলত ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং এ জ্ঞানকে অন্যের কাছে পূর্ণ ও যথার্থরূপে ব্যক্ত করা যায় না। তবে স্বজ্ঞাপ্রসূত জ্ঞান ব্যক্তিগত ব্যাপার হলেও এর একটা জ্ঞানজ আধেয় (cognitive content) রয়েছে বলে এ জ্ঞানকে ইকবাল বস্তুনিষ্ঠ বলে মনে করেন। তাই স্বজ্ঞার মাধ্যমে প্রাপ্ত মরমী অভিজ্ঞতা বাস্তব ও অস্তিত্বধর্মী।

 তৃতীয়ত, স্বজ্ঞা অবিশ্লেষণধর্মী সমগ্র। সজ্ঞার ক্ষেত্রে বিষয়ী (subject) ও বিষয়-এর (object) মধ্যে কোন পার্থক্য করা যায় না। অর্থাৎ এক্ষেত্রে জ্ঞান ও জ্ঞেয় বস্তুর ব্যবধান ঘুচে যায়, কেননা এক্ষেত্রে সমগ্র সত্তা একটি অবিভাজ্য ঐক্য হিসেবে উপস্থাপিত হয়। এ ধরনের মরমী অভিজ্ঞতায় জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বস্তুর ব্যবধান তিরোহিত সব কিছু একাকার হয়ে যায়। মরমী অভিজ্ঞতা সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকে পৃথক,কেননা সাধারণ অভিজ্ঞতায় জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বস্তুর ব্যবধান তিরোহিত হয় না। আর সেজন্যই সাধারণ অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণধর্মী। কিন্তু মরমী অভিজ্ঞতায় এ ধরনের বিশ্লেষণ সম্ভব নয়, কেননা এ ক্ষেত্রে পরম সত্তা এক অবিশ্লেষণধর্মী ঐক্যের প্রতীক। 

 চতুর্থত, যজ্ঞাপ্রসূত অভিজ্ঞতায় পরম সত্তা নিজেকে এক অনন্য আত্মা বা ব্যক্তি হিসেবে ব্যক্ত করে থাকে। এই আত্মা অভিজ্ঞতামূলক আত্মাকে অতিক্রম করে। তবে এই আত্মা অতিবর্তী ও অন্তর্বর্তী উভয়ই। এক্ষেত্রে বিষয়ী ও বিষয়ের সাধারণ পার্থক্য প্রযোজ্য নয়। মরমী অভিজ্ঞতায় মরমী সাধক পরম সত্তার সাথে পূর্ণ ঐক্য অনুভব করেন।


 পঞ্চমত, 
স্বজ্ঞাপ্রসূত অভিজ্ঞতায় ক্রমিক কাল-এর ধারণা বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং কাল তখন একটি স্থায়ী স্থিতিকাল হিসেবে ব্যক্ত হয়। মরমী অভিজ্ঞতায় মরমী সাধক পরম সত্তাকে আংশিকভাবে উপলব্ধি করেন না, বরং সামগ্রিকভাবে উপলব্ধি করেন বলে তার কাছে মনে হয়। ইকবালের দর্শনে বার্গসোঁর ভাবধারার প্রভাব থাকলেও স্বজ্ঞা সম্পর্কিত ইকবালের ধারণা বার্গসোঁর ধারণা থেকে পৃথক। বার্গসো স্বজ্ঞাকে এক বৌদ্ধিক সহানুভূতি (intellectual sympathy) বলে মনে করেন। বার্গসোঁর মতে, স্বজ্ঞাপ্রসূত অভিজ্ঞতায় স্মৃতি সম্পর্কিত উপাদানকে বিয়োজন করতে হবে। কিন্তু ইকবালের মতে, এ ধরনের বিয়োজন আত্মার অস্বীকৃতিকে বোঝায়, কেননা আত্মার ধারণা স্মৃতির সমন্বয়ে গঠিত হয়ে থাকে। বস্তুত, আত্মা অতীত ও বর্তমান মানসিক অবস্থাসমূহের এক অনন্য পারস্পরিক সম্বন্ধ।

 আল্লামা ইকবালের খুদী (Self of Ego) এর বিশ্লেষণ :


ইকবালের দর্শনের মূল সূর হলো খুদী। ‘খুদী'র ধারণার উপরই ইকবাল দর্শনের সৌধ স্থাপিত। তাঁর মতে, খুদী বাস্তব সত্তা— নিজের জোরেই এই সত্তা অস্তিত্বশীল। অতীন্দ্রিয় অনুভূতির মাধ্যমে আমরা এই সত্তার সাক্ষাৎ পেয়ে থাকি। খুদীর স্বজ্ঞাতিক জ্ঞান আমাদের অভিজ্ঞতার বাস্তবতা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অবিচল আস্থা সৃষ্টি করে। স্বজ্ঞার মাধ্যমে শুধু খুদীর অস্তিত্ব সম্পর্কেই জানা যায় না, এর স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও জানা যায়।

 স্বজ্ঞার মাধ্যমে জ্ঞাত খুদী মূলত নিয়ামক, স্বাধীন অমর। সর্বখোদাবাদী (Pantheists) দার্শনিকরা খুদীর অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। তারা পরিদৃশ্যমান জগতকে অবাস্তব এবং অলীক বলে মনে করেন। জগৎ সত্তার অস্বীকৃতি মানুষ ও তার নৈতিক এবং সামাজিক দায়িত্ব কর্তব্য, আশা-আকাঙ্ক্ষার বিলুপ্তি ঘোষণা করে। এভাবে ব্যক্তিগত জাতীয় জীবনের সকল অগ্রগতি ও কর্মচাঞ্চল্যকে স্তরীভূত করে দিয়ে এক সীমাহীন কর্মহীনতা ও শূন্যতা ঘোষণা করে সর্বখোদাবাদ বা প্যানথিজম। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, সর্বখোদাবাদ জীবন বিরোধী ও কর্মবিমুখ ইকবাল তাঁর দার্শনিক জীবনের প্রথম স্তরে সর্বখোদাবাদের জৌলুসে মুগ্ধ হলেও পরবর্তীকালে এই মতবাদেও মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয় অবগত হয়ে এর বিরোধিতা করেন। 

প্যানথিজমের বিরুদ্ধে ইকবালের প্রথম অভিযোগ হলো সংবেদনাত্মক ও প্রত্যক্ষণজাত জ্ঞানকে অস্বীকার করা চলে না। জগৎ অস্তিত্বশীল; আমরা জগতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারি না। যদিও সর্বখোদাবাদী দার্শনিকদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার অসারতা, জগতের অলীকত্ব সম্পর্কে সক্রোশ করেন তথাপি তাঁরা সম্পূর্ণভাবে তাঁদের মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। 


ইকবালের দ্বিতীয় অভিযোগ হলো খুদীর অস্তিত্ব প্যানথিজমের পরিপন্থি। খুদীর অস্তিত্ব যে বাস্তব তা সর্বখোদাবাদী দার্শনকিরা সম্পূর্ণভাবে উড়িয়ে দিতে পারেননি। বাস্তব জগতের অস্তিত্ব প্রমাণ করা সর্বখোদাবাদীদের পক্ষে অপরিহার্য এবং প্রমাণের ক্ষেত্রে হয় জগতকে খোদা হতে নিঃসৃত নতুবা খোদার প্রকাশ হিসেবে গ্রহণ করা ব্যতীত অন্য পন্থা খোলা নেই। এই দ্বিবিধ ব্যাখ্যাই শেষ পর্যন্ত জগতের বিভিন্ন ধরনের সত্তার অস্তিত্বে উপনীত হতে নির্দেশ করে। আর যে ধরনের সত্তার সঙ্গে খোদার স্বরূপের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে সে गा অন্যবিধ সত্তার তুলনায় অধিক বাস্তবধর্ম। কাজেই খুদীর উচ্চতর অস্তিত্ব সর্বখোদাবাদী যুক্তির মাধ্যমে নস্যাৎ করা সম্ভব নয়। এভাবে ক্রমশ ইকবাল জগতের অপর সবকিছুর ঊর্ধ্বে খুদীর প্রভুত্ব ও প্রভাব প্রদর্শন করতে অগ্রসর হতে থাকেন। ইকবালের শিক্ষক ম্যাকট্যাগার্ট (Mactaggert) তাকে প্রভাবিত করেন। 

ম্যাকট্যাগার্ট-এর যুক্তি পদ্ধতি অনুসরণ করে ইকবাল পরম সত্তা ও আত্মার স্বাতন্ত্র্য্য সম্পর্কে নিশ্চিত হন। সর্বখোদাবাদ (pantheism)-এর সমালোচনাকালে ইকবাল সেখান যে, খুদী বা আত্মা বাস্তব ও অস্তিত্বশীল। কাজেই পরম সত্তার আত্মবিলুপ্তি খুদীর লক্ষ্য হতে পারে না। পরম সত্তার আত্মা বিলুপ্তি খুদীর অস্তিত্বের পরিপন্থী। আমি অস্তিত্ববিহীন অবাস্তব, এই অবস্থা মানুষের চিন্তা ও বাস্তব সত্তার বিরোধী ("আমি চিন্তা করি, কাজেই আমি অস্তিত্বশীল' ডেকার্টের এই প্রসিদ্ধ উক্তির তাৎপর্য এই যে আমাদের চিন্তা নির্দেশ করে চিন্তার মূলে, চিন্তন ক্রিয়ার কর্তারূপে ব্যক্তির অস্তিত্ব সন্দেহাতীত। অনুরূপভাবে প্রত্যেক ক্রিয়াই একজন কর্তার নির্দেশক, 'আমি ইচ্ছা করি, কাজেই আমি অস্তিত্বশীল'। এ পর্যন্ত উভয় দিক থেকেই খুদী ধারণাগত।) 

 ইকবালের মতে, অন্য পথেও আমরা আত্মাকে জানতে পারি। তিনি বলেন যে, অতীন্দ্রিয় অনুভূতির মাধ্যমে আমরা খুদীকে সরাসরি জানতে পারি। খুনীকে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হিসেবেই আমরা সর্বপেক্ষা বাস্তব সত্তা হিসেবে জানতে পারি। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বিরাট কার্য ও গভীর অনুভূতির সময়েই খুদীর অস্তিত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া যায়। সংগ্রাম ও সক্রিয়তার মাধ্যমেই আমাদের অস্তিত্বের ব্যাপর তাৎপর্য ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে। আমাদের সকল ক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেই খুনীর প্রকাশ। এটাই আমাদের ব্যক্তিত্বের আধার, এটাই আমাদের খুদী। আমাদের ইচ্ছা, অনিচ্ছা, বিচার-বিবেচনা, সিদ্ধান্তের মধ্যে খুদীই ক্রিয়াশীল। খুদীকে আমরা কোনো মাধ্যমের সাহায্যে অবগত হই না, সরাসরি প্রত্যক্ষ করে থাকি। খুদীর অস্তিত্ব ও বাস্তবতা নিশ্চিতভাবে জানা যায় স্বজ্ঞার সাহায্যে।'

 খুদী বা আত্মার স্বরূপ কি?


গাযালী আত্মাকে মানসিক অবস্থা ও অভিজ্ঞ পৃথকী সত্তা (entity) বলে মনে করেন। মানসিক অবস্থা পরিবর্তনশীল কিন্তু আধ্যাত্মিক দ্রব্য (আত্মা) পরিবর্তনের আওতামুক্ত। 

 প্রথমত, আত্মার এই ধরনের সংজ্ঞা নির্দেশ করে যে, আত্মা একটা পুরা বৈজ্ঞানিক ধারণা বা আমাদের অভিজ্ঞতার জন্য প্রকল্পিত হয়। এটা কি দ্রব্যগুণের মত অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কযুক্ত, এতে কি আমাদের অভিজ্ঞতা স্থিত, যেমন দ্রব্যের মধ্যে গুণ ব্যস্ত? নিশ্চয়ই নয়।

 দ্বিতীয়ত, অভিজ্ঞতার ঐক্য, যার উপর আত্মার সরলতা এবং অপরিবর্তনীয় নির্ভর করে, তা আত্মার অবিভাজ্যতা কিংবা অপরিবর্তনীয়তা প্রমাণ করে না। আত্মা দ্রব্য মতবাদের বিপক্ষে কান্ট এই ধরনের সমালোচনা করেন।

 তৃতীয়ত, এই মতবাদ মনোবিজ্ঞানের দ্বৈতব্যক্তিত্ব (double personality) মতবাদ ব্যাখ্যা করতে পারে না। আত্মার স্বরূপ বিশ্লেষণে মনোবিজ্ঞানের অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদ আমাদের বিশেষ সাহায্য করতে পারে না। এই মতবাদ মন বা আত্মা বলতে পরিবর্তনশীল সংবেদন, অনুভূতি ও চিন্তার প্রবাহ। এই মতবাদ বিভিন্ন মানসিক ক্রিয়াকে পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করে, এবং তাদের অন্তর্নিহিত ঐক্যের নির্দেশ দেয় না। সকল মানসিক প্রক্রিয়ার মূলে যে এক ঐক্যসূত্র কাজ করেছে, সে ঐক্যসূত্র সকল অভিজ্ঞতার কেন্দ্রবিন্দু, মনোবিজ্ঞান আমাদেরকে আত্মার এই স্বরূপের পরিচিত করাতে পারে না। কাজেই ইকবাল বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ পরির্তন করেন এবং স্বজ্ঞার মাধ্যমে খুনী আত্মার স্বরূপ উদ্ঘাটন করেন। তাঁর মতে, স্বজ্ঞা বা অতীন্দ্রিয় অনুভূতির মাধ্যমে আত্মার বা খুদীর প্রকৃত স্বরূপ অবহিত হওয়া যায়। কিন্তু ভাষায় খুদীর অভিজ্ঞতার বর্ণনা বিপদসঙ্কুল ও দুরূহ, কাজেই এ ধরনের বর্ণনা অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ, কেননা ভাষা ও যুক্তি পদ্ধতি প্রাচীন চিন্তাপদ্ধতি ও দার্শনিক মতবাদসমূহের বাহন।

 খুদী বা আত্মা অভিজ্ঞতার যাতায়াত (Come and go of experience) বলে মনোবিজ্ঞানীরা যে মতবাদ পোষণ করেন তা সত্য; কিন্তু এই সকল অভিজ্ঞতা পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়। এরা পৃথকভাবে অবস্থান করে না কিংবা এদের পৃথকভাবে অবস্থান করতে দেখা যায় না। অভিজ্ঞতা বিরামহীন। সংবেদন অনুভূতি, চিন্তা ইত্যাদি নিরন্তর প্রবাহ। আমাদের মধ্যে পরিবর্তনবিহীন পারস্পর্য রয়েছে, এক বিশুদ্ধ গতি। এই বহুত্বের অন্তরালে ঐক্য রয়েছে, যা অংশসমূহকে সমগ্রের সঙ্গে যুক্ত করে যেমন সূতা ফুলকে মালায় পরিণতি দান করে। এই অবস্থাকে বার্গসোঁর ভাষায় ঐক্যের মধ্যে বহুত্ব এবং বহুত্বের মধ্যে ঐক্য বলা চলে।

আল্লামা ইকবাল ঐক্য বলতে মনে করেন যে, বিভিন্ন অভিজ্ঞতা একটি মাত্র অহম বা খুদী (ego oral) দ্বারা অনুভূত।' খুদাই বিভিন্ন ক্রিয়া ও অভিজ্ঞতাকে অনুভব করে খুনী স্বীয় ক্রিয়াবলির মাধ্যমে নিজের মূল্যায়ন করে (appreciates )। কাজেই খুনী স্বরূপত মূল্যায়নমূলক (appreciative)। অর্জন ব্যতীত মূল্যায়ন নেই এবং লক্ষ্য ছাড়া অর্জন নেই। কাজেই খুদী বা আত্মা সর্বদা কোনো না কোনো দিকে অগ্রসর হয় এবং এটা wwf (directive) ।

 এ হতে প্রতীয়মান হয় যে, খুদীর অস্তিত্ব বা জীবন মূলত ইচ্ছাময়। ইচ্ছা ক্রিয়ায় ও অভিজ্ঞনের উপর নির্ভর করে। ইচ্ছা ও কর্মবিহীন মানুষ জীবনবর্ণিত নিষ্প্রাণ। প্রচেষ্টা ও ইচ্ছার দিকে মানুষ যতই অগ্রসর হবে, জীবনের পথে সে ততই উন্নত হবে। ইচ্ছাময় জীবনই সম্প্রসারণশীল। ইচ্ছাই জীবনের বিভিন্ন দিগন্ত মানুষের নিকট ব্যক্ত করে, ইচ্ছা বা আকিঞ্চনের সৃষ্টিশীল শক্তি আমাদের ব্যক্তিত্বের উৎস। ইচ্ছার ক্রমবর্ধমান সম্প্রসারণশীলতার ফলেই হুদী শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের রূপ লাভ করে থাকে। গতিতে। জীবনময়: স্থিতিতে মরণ (হাস্তান আগার মীরওয়াম পার মারওয়াম নিস্তাম)।

 ইচ্ছা (খুদী বা আত্মা) প্রেমের দ্বারা বলিয়ান হয়। প্রেম ইচ্ছাকে শক্তি প্রদান করে, নবজীবন দান করে। এটা জীবনের নুতন তাৎপর্য দান করে, জীবনকে নব বলে বলিয়ান করে তোলে। প্রেম খুদীকে সুরক্ষিত করে (The Ego is fortified by love Ishq) মূল্য ও আদর্শের সৃষ্টি ও তার রূপায়ন প্রয়াস খুদীর সর্বোচ্চ রূপ । খুদী কোনো না কোনো পরিবেশের মধ্যেই বিকাশ লাভ করে। কিন্তু এই পরিবেশ খুদীকে যান্ত্রিকভাবে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে না। বরং খুদীই পরিবেশকে (বাহা এবং আন্তর) নিজের ইচ্ছা, আকিঞ্চন ও আদর্শের দ্বার নিয়ন্ত্রিত করে, রূপ দেয়। কাজেই খুদী স্বাধীন ব্যক্তিগত কার্যকারণতত্ত্ব ইতর প্রাণী ও মানুষের আচরণের মধ্যে প্রভেদের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে এর অধিকার পরিস্ফুট হয়ে উঠে। ইতর প্রাণী সহজাত প্রবৃত্তির বশেই তাঁর পরিবেশে সঙ্গে খাপ খাইয়ে থাকে। কিন্তু মানুষ তাঁর উদ্দেশ্যের প্রেক্ষিতে পরিবেশকে নিয়ন্ত্রিত করে। পরিবেশকে নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন করার জন্য ও পরিবেশের উপর শীয় প্রভুত্ব স্থাপনের জন্য মানুষ তাঁর ইচ্ছার স্বাধীনতাকে সম্প্রসারিত করে এবং গুদী বিকশিত করে। খুদীর ক্রিয়াবলির মধ্যে নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রিত থেকে প্রমা যে, খুনী স্বাধীন সত্তা স্বাধীনভাবে কাজ করার উপরেই মানুষের উন্নতি ও অবনতি নির্ভর করে।

 ঊর্ধ্ব থেকে ঊর্ধ্বতর স্তরে উন্নীত হতে হলে খুদীকে নিরন্তর কর্ম প্রচেষ্টা চালিয়ে হবে, আকাঙ্ক্ষার দীপ্তিতে উত্তরোত্তর উদ্ভাসিত হতে হবে। কোরআনের তকদীর সম্পর্কীয় ধারণা খুদীর স্বাধীনতা অস্বীকার করে না। ভাগ্য খুদীর পক্ষে কোনো নির্ধারিত কর্মসূচি নয়, খুদী স্বাধীনভাবে নিজের পন্থা নির্বাচন ও নিজে ইচ্ছামাফিক ক্রিয়া করতে পারে। ইকবাল বলেন, “নিয়তি খুদীর আন্তর পরিণতি। খুদী তাঁর আন্তর সম্ভাবনা, আকাঙ্ক্ষা ও আদর্শের দ্বারা পরিচালিত। খুদী শুধু স্বাধীন নয়, বরং অবিনশ্বরও। কিন্তু খুদীর এই অবিনশ্বরতা অর্জনসাপেক্ষ। নিরন্তর প্রচেষ্টার মাধ্যমেই এই অমরতা অর্জন করতে হবে।

 ইকবাল বলেন, “অমরতা আমাদের অধিকার নয়; ব্যক্তিগত চেষ্টার দ্বারাই এটা অর্জন করতে হয়।” নিরন্তর কর্মের মাধ্যমেই মানুষ অমরতার অধিকারী হয়। অলস কর্মবিমুখ মানুষের মধ্যে খুদীর ক্ষীণ ধারণা চমকিত হয়ে মিলে যায়। স্থায়ী অস্তিত্বের গভীর প্রত্যয় জন্মে না।



আল্লামা ইকবালের উক্তি-

 ইকবাল বলেন, “অমরতা আমাদের অধিকার নয়; ব্যক্তিগত চেষ্টার দ্বারাই এটা অর্জন করতে হয়।” "

  • তোমার পথ আমার নয়, বরং ফকির তোমার জন্য প্রযোজ্য।"

  • "দৃঢ় বিশ্বাস, অবিরাম প্রচেষ্টা এবং বিশ্বজয়ী প্রেম মানুষের হাতিয়ার।"
  • "বিশ্বাস, চিন্তা এবং আবিষ্কার একটি সুন্দর জীবনের তিনটি নক্ষত্র।"

  • "খোদা তোমার রহস্যময় পোশাকের মধ্যে তোমার আমিটির ভেতর  লুকিয়ে আছেন।"

  • "পৃথিবীটা  তোমার জন্য,তুমি পৃথীবির জন্য নয়।"

  • "আমার দৃষ্টিতে দেশ প্রেম আর দেশপূজা এক জিনিস নয়"

  • "গুরুপ্রেমে কাফের ফতোয়া না পেলে পীর পূজারি হব কী করে?"

  • "হে নবী! যদি তোমার ভালবাসা যদি না পাই, নামাজ আমার না দেয় , আমার রুকু-সিজদা বৃথা।

  • "স্কুলে পড়ে নয়, বইয়ের পাতা পড়ে নয়, সত্যিকারের মানুষ তৈরি হয়, বড়দের এক নজরে।"

  • "খোদা তুমি যে বেহেশত বানিয়েছ মোল্লাদেরকে দাও। আমি বেসেশত চাই না; আমি শুধু তোমার রহস্যে ডুবে থাকতে চাই!





#আল্লামা_ইকবালের_কবিতা
#আল্লামা_ইকবালের_কবিতা_বাংলায়
#আল্লামা_ইকবালের_গজল
#আল্লামা_ইকবালের_উক্তি
#আল্লামা_ইকবালের_প্রেমের কবিতা
#আল্লামা_ইকবালের_কবিতা_বাংলা অনুবাদ
#আল্লামা_ইকবালের_সেরা কবিতা
#আল্লামা_ইকবালের_দর্শন_শাস্ত্রে_অবদান
#আল্লামা_ইকবালের_দর্শন ত্বত্ত্ব
#আল্লামা_ইকবালের_জীবনী
#Allama_Iqbaler_Life_history
#Life_history_of_All AMA Iqbal
#ইকবালের_খুদি_দর্শন
#ইকবালের_মতে_আত্মা কি?
#ইকবালের_গান
#ইকবালের_কবিতা
#Allama_Iqbal_poetry_in_Bangla
#Bangla_poeam
#Bangla_kobita
#কবিতা_বাংলা
#কবিতা_বাংলা
#আল্লামা_ইকবালের_গজল
#আল্লামা_ইকবালের_নিউজ
#নিউজ #মহা কবি আল্লামা ইকবাল
#Newstoday # আল্লামা ইকবালের বই পিডিএফ

 


Post a Comment

Previous Post Next Post