মানসিক স্বাস্থ্য বা ব্রেইন ভালো রাখে যে খাবারগুলো।

মানসিক স্বাস্থ্য উন্নতি করার উপায় কি? 


আমরা এখন সবাই হোম কোয়ারেন্টিনে আছি। বেশিরভাগ মানুষই অলস জীবন যাপন করছি। কিন্তু আমাদের একটি অঙ্গ কখনোই অলস বসে নেই। আর তা হলো আমাদের মস্তিষ্ক। হ্যাঁ, আমাদের মস্তিষ্কই এখন সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত আছে। এমনকি ঘুমের মধ্যে সচল থাকে যে অঙ্গটি তা হলো আমাদের মস্তিষ্ক বা ব্রেইন। ২৪/৭ যে অঙ্গটি কাজ করতে থাকে তার জ্বালানীও ২৪/৭ ই সরবরাহ করতে হয়। আর এই জ্বালানী আসে আমরা প্রতিদিন যা খাই তা থেকে। খাবার থেকে আসা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান আমাদের মস্তিষ্ক সচল রাখে, দুশ্চিন্তা, হতাশা বা ডিপ্রেশানের মত ব্যাধিগুলো থেকেও মুক্ত রাখে এবং মুড ও ভালো রাখতে পারে এইসব পুষ্টি উপাদানগুলো।

মানসিক স্বাস্থ্য বা আমাদের ব্রেইন ভালো রাখে যে পুষ্টি উপাদানগুলো এবং এদের উৎস সমূহঃ


১। ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড- ব্রেইনের ৬০% হলো ফ্যাট যার অর্ধেকই ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড। ব্রেইনের নার্ভ সেল, মেমোরি গঠন, বাচ্চাদের শিখতে বা মনে রাখতে এবং বার্ধক্যজনিত মস্তিষ্ক বিকৃতি বা Alzheimer's রোগ এর ঝোক কমায় ওমেগা ৩ ফ্যটি এসিড। এছাড়াও ডিপ্রেশন বা বাইপোলার ডিপ্রেশন, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় ওমেগা ৩

উৎসঃ সবচেয়ে ভালো উৎস হলো কর্ড লিভার অয়েল (সাপ্লিমেন্ট)। এছাড়াও সামুদ্রিক চর্বিযুক্ত মাছ যেমন, স্যামন, সার্ডিন, টুনা মাছেও প্রচুর পরিমানে ওমেগা ৩। তবে আমাদের দেশে ওমেগা ৩ যুক্ত ডিম, ইলিশ, কোরাল মাছ, সামুদ্রিক গলদা চিংড়ি, আখ্রুট, ফ্লেক্সসীড বা স্পিরুলিনা সাপ্লিমেন্টেও পাওয়া যায় এই ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড।

২। ম্যাগনেসিয়াম- মুড সুয়িং, ব্যক্তিত্ব পরিবর্তন, ডিপ্রেশন, দুশ্চিন্তা, উদাসীনতা, দ্বিধাগ্রস্থতা, প্রলাপ বকার মত মানসিক ব্যাধির সাথে সরাসরি সম্পর্ক আছে ম্যাগনেসিয়াম ঘাটতির। একে ব্রেইনের ২য় খাবারও বলা হয়। গড়ে প্রতিদিন একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের ৪০০ মিগ্রা. আর মহিলার ৩০০ মিগ্রা. ম্যাগনেসিয়াম প্রয়োজন হয়।

ম্যাগনেসিয়ামের উৎসঃ

গাঢ় সবুজ শাক, কলা, ডুমুর, এভোকাডো, বিভিন্ন রকম বাদাম ও বীজ যেমন, চিনাবাদাম, কাঠ বাদাম, মিষ্টি কুমড়ার বীচি, ডাল( কালো ডাল, কিডনি বিন), মটরশুটি, বরবটি, ব্রকলিতে প্রচুর ম্যাগনেসিয়াম পাওয়া যায়। এছাড়া স্যামন, ম্যাকরেল ইত্যাদি সামুদ্রিক মাছ ও ঢেকী ছাঁটা লাল চালেও ম্যাগনেসিয়াম থাকে।


। ভিটামিন বি কমপ্লেক্স

 মানসিক স্বাস্থ্য ও স্নায়ুবিক সুস্থ্যতার জন্য আরও একটি গুরুত্বপুর্ণ উপাদান হলো বি ভিটামিনস, যা মূলত থায়ামিন, নায়াসিন, রিবোফ্লাভিন, পিরিডক্সিন, ফোলেট এর মত আরও কয়েকটি বিশেষ পুষ্টি উপাদান নিয়ে কাজ করে। এই উপাদানগুলো পানিতে দ্রবনীয় তাই শরীরে জমা থাকে না। তাই আমাদের প্রতিদিনের খাবারের মাধ্যমে ফোলেটসহ অন্যান্য বি ভিটামিনের চাহিদা পূরণ করতে হয়। কারন এক একটি ভিটামিনের ঘাটতিতে এক ধরনের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়।


ভিটামিন ১ (থায়ামিন)- থায়ামিনের অভাব হলে ডিপ্রেশনজনিত সমস্যা হতে পারে।

উৎসঃ ডাল ও বীচি জাতীয় সবজি, দই, ডিম, মাংস (ঘাস খাওয়ানো গরুর মাংস, মুরগি),মাছ, বাদাম,পালং শাক ইত্যাদি থায়ামিনের ভালো উৎস

ভিটামিন বি ৩ (নায়াসিন)- এর অভাবে পেলেগ্রা হয়ে থাকে যা সাইকোসিস ও ডিমেনশিয়ার কারন, এছাড়া মানসিক উত্তেজনা, দুশ্চিন্তা, এমনকি মানসিক ও শারীরিক অলসতা দূর করতে প্রয়োজন হয় নায়াসিন।

উৎসঃ ডাল, দুধ ও দুগ্ধজাতীয় পন্য, বাদাম, ডিম, মাংস (ঘাস খাওয়ানো গরুর মাংস, মুরগি),মাছ ইত্যাদি থেকে আমরা নায়াসিন পেয়ে থাকি।

ভিটামিন বি ৫ (প্যান্টোথেনিক এসিড)- এর অভাবে মাথা ঘুরানো, ডিপ্রেশন, ঘুম না হওয়া, দুশ্চিন্তাগ্রস্থতা দেখা দেয়।

✅✅উৎসঃ ডিম, দুধ, দই, মুরগি, ডাল, টুনামাছ, লাল আটা, ব্রকলিতে ভিটামিন বি ৫ পাওয়া যায়।

ভিটামিন বি ৬ (পিরিডক্সিন)- যা সেরেটোনিন, মেলাটোনিন, ডোপামিন এর মত গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের তৈরিতে অত্যাবশ্যকীয়। এদের ঘাটতিতে দূর্বল ইমিউনিটি, চর্মরোগ, মানসিক দ্বিধাগ্রস্থতা, ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়।

✅✅উৎসঃ গরুর কলিজা, মুরগি, স্যামন, টুনা, কলা, আলু, মটর, কটেজ চীজ থেকে ভিটামিন বি ৬ পাওয়া যায়। 

ভিটামিন বি ৯ (ফোলেট)- গর্ভবতী মায়েদের ফোলেটের ঘাটতিতে রক্তসল্পতার পাশাপাশি গর্ভের বাচ্চার নিউরাল টিউব ডিফেক্ট হতে পারে, যা বাচ্চার পরবর্তীতে মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।

✅✅উৎসঃ গাঢ় সবুজ শাক, কলিজা, মটর, সূর্যমুখী বীজ, চিনাবাদাম ইত্যাদিতে ফোলেট থাকে। তবে গর্ভবতীকালীন সময়ে সাপ্লিমেন্ট আকারে ফোলেট গ্রহন করা উত্তম।

ভিটামিন বি ১২ (কোবালামিন)- এর অভাবেও পারনিসিয়াস এনিমিয়া হয়ে থাকে, বি ১২ এর ঘটতি বয়স্কদের মাঝে বেশি হয় যার ফলে ডিমেনশিয়া, ডিপ্রেশন সহ আরও অনেক নিউরোলজিকাল ও সাইকোলজিকাল সমস্যা দেখা দেয়।

✅✅উৎসঃ মাংস (ঘাস খাওয়ানো গরুর মাংস, মুরগি), ডিম, দুধ ,দই এ বি ১২ পাওয়া যায়।

৪। ভিটামিন সি – খুব সামান্য পরিমান ভিটামিন সি দিয়েই ডিপ্রেশন রোগীর উন্নতি করা সম্ভব। ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মুড ভালো রাখে, রাগ, দ্বিধাগ্রস্থতা, স্ট্রেস, গর্ভাবস্থায় মানসিক ক্লান্তি দূর ক্রতে সাহায্য করে।

✅✅উৎসঃ পেয়াঁরা, আমলকি, লেবু, কমলা, জাম্বুরা, কাচাঁ মরিচ, ব্রকলি, টমেটো ইত্যাদি তাজা ফল ও সব্জিতে প্রচুর ভিটামিন সি পাওয়া যায়।

৫। ভিটামিন ডি – বিভিন্ন গবেষনায় দেখা যায় যাদের ভিটামিন ডি ঘাটতি আছে এবং রোদের আলোতে যারা কম যান, তাদের মধ্যে ডিপ্রেশনের প্রবনতা বেশি থাকে। তাই ডিপ্রেশনের রোগীদের ভিটামিন ডি প্রোফাইল ঠিক রাখতে অনেক ডাক্তারই নির্দেশ দিয়ে থাকেন।

ভিটামিন ডি এর উৎসঃ যেহেতু সূর্যের আলোর প্রভাবে  ডি ভিটামিন আমাদের শরীরে তৈরি হয়, কাজেই দিনে অন্তত ৩০-৪০ মিনিট শরীরে রোদ লাগানো উচিত। এছাড়া সামুদ্রিক চর্বি যুক্ত মাছ, গরুর কলিজা, ডিমের কুসুম, ডি ফরটিফাইড দুধ, পনির, মাশরুম এ ভিটামিন ডি পাওয়া যায়।

৬। জিংক – অল্প পরিমানে শরীরে প্রয়োজন হলেও এর অভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, পেটের পীড়া দেখা যায় ,যার ফলে অনেক সময় দীর্ঘ মেয়াদি মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।

✅✅উৎসঃ মাংস (ঘাস খাওয়ানো গরুর মাংস, মুরগি), সামুদ্রিক মাছ, ওয়েস্টার, ক্রেব, সামুদ্রিক চিংড়ি, কাজুবাদাম, মিষ্টিকুমড়া বীজ, মটর, কিডনী বিন্স ইত্যাদি।

৭। সেরেটোনিন – ট্রিপ্টোফ্যান জাত এই উপাদানটি সরাসরি আমাদের মুড উন্নত করতে কাজ করে, পাশাপাশি ডিপ্রেশন, ঘুম না হওয়া, দুশ্চিন্তা প্রতিরোধে কাজ করে।

✅✅উৎসঃ ডিম, স্যামন, আনারস, বীজ ও বাদাম, পনির, ওটস, গরুর মাংস, কলিজা ইত্যাদিতে সেরেটোনিন পাওয়া যায়।

৮। ভিটামিন ই – Alzheimer রোগীদের চিকিৎসায় ভিটামিন ই ব্যবহার করা হয়, এন্টি অক্সিডেন্ট হওয়ায় এটি বিভিন্ন রকম অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায়, ফলে মুড ভালো থাকে, ডিপ্রেশন প্রতিরোধ করে।

✅✅উৎসঃ সূর্যমুখী বীজ, চিনা বাদাম, এভোকাডো, কাঠবাদাম, পালং শাক, ব্রকলি।

৯। শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম – নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম, দিনে কমপক্ষে ৩০-৪০ মিনিট হাঁটা, সপ্তাহে কমপক্ষে ৩-৪ দিন হালকা থেকে মাঝারি ব্যায়াম, ইয়োগা, মেডিটেসন মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে ফলপ্রসু কাজ করে। বর্তমানে যারা হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন বা বাহিরে গিয়ে হাঁটতে পারেন না তারা ঘরে বসেই সুবিধা মত ব্যায়ামটি নিয়মিত করুন, মানসিকভানে প্রফুল্ল থাকুন।

১০। পানি- নিয়মিত পানি পান সুস্থ মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়ক। দিনের শুরুটা এক গ্লাস এলকালাইন পানি, বা হালকা গরম স্বাভাবিক পানি দিয়ে শুরু করলে এবং প্রতি বেলা খাবারের আগে ও পরে পানি পান করলে দেহ মন দুইই চাঙ্গা থাকে, মানসিক প্রফুল্লতা বজায় থাকে।
এছাড়া কফি, গ্রিন টি আমাদের মুড চাঙ্গা রাখে, মানসিক প্রশান্তি প্রদান করে, তবে তা অবশ্যই চিনিমুক্ত হতে হবে।

সর্বোপরি সুষম খ্যাদ্যভাস, স্বাস্থ্যকর জীবন ব্যবস্থা ও শারীরিক পরিশ্রমের সম্মিলিত প্রয়াসেই সুস্থ মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সম্ভব.


Post a Comment

Previous Post Next Post