আর কত দূর্ঘটনা চাই? আর কত অবহেলা?

আর কত দূর্ঘটনা চাই? আর কত অবহেলা?




উইকিপিডিয়ার মতে,  বাংলাদেশ এশিয়ার সপ্তম বৃহৎ গ্যাস উৎপাদনকারী একটি দেশ। দেশীয় জ্বালানির ৫৬ শতাংশ পূরণ করে আসলেও বর্তমানে দেশটিকে হিমসিম খেতে হচ্ছে জ্বালানি নিয়ে।  গত ১০ বছরে উল্লেখযোগ্য কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়ে উঠেনি। ফলে জ্বালানি সমস্যা দূর করতে সরকার সিলিন্ডার গ্যাস আমদানি করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে প্রচুর পরিমাণে অর্থ ব্যয় হচ্ছে। সারা দেশে গ্যাস বিতরণের জন্য ৬টি কোম্পানি রয়েছে। সেগুলো হলো যথাক্রমে তিতাস, কর্ণফুলী,পশ্চিমাঞ্চল, জালালাবাদ, বাখরাবাদ ও সুন্দরবন।  "মিনিস্ট্রি অফ পাওয়ার এনার্জি এন্ড মিনারেল রিসোর্স" এর মতে, সারা দেশে বৈধ আবাসিক গ্রাহক রয়েছে প্রায় ৩৮ লাখের মত।  এর মধ্যে তিতাসের গ্রাহক সংখ্যা ২৮ লাখের বেশি।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এবং অবকাঠামোগত ক্রম অগ্রগতিতে নিত্যনতুন বিলাসবহুল বাড়ি এবং শিল্পকারখানা বৃদ্ধির ফলে বিদ্যুতের চাহিদার সাথে সাথে গ্যাসের ব্যবহার বাড়লেও গ্যাস উৎপাদনের বেলায় ঠিক যেন তার উল্টো।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এখন বাংলাদেশের যে পরিমাণ গ্যাস মজুত রয়েছে তা  আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো কেন এত দ্রুত শেষ  হবে?



২০০৯ সালে সরকার শিল্প কারখানা ও বাণিজ্যিক এলাকার পর যখন আবাসিক এলাকায়ও নতুন গ্যাস সংযোগ সাময়িক ভাবে বন্ধ ঘোষণা করে তখন থেকে বেড়ে যায় অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ  দেয়ার প্রবণতা। অদ্যাবধি পত্রিকা খুল্লেই দেখা যায় অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগের মহড়া।  ঠিকাদার থেকে শুরু করে উপরের পর্যায়ের খুব কম কর্মকর্তাই যেন বাকি যে এই অবৈধ কাজের সাথে জড়িত হয়নি।
ছোট ছোট ঠিকাদার রা  যেন হয়ে উঠেছে আঙুল ফুলে কলা গাছ। চোরাই ভাবে তারা প্রতি সংযোগে নিচ্ছে ২৫-৩০ হাজার টাকা করে।  বিদ্যুৎ এর মত মিটার ব্যবস্থা না থাকায় এভাবে তারা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অবৈধ সংযোগ দেয়ার মাধ্যমে।  মনে হচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাহিরে তাদের দূর্নীতির শেকড়।
এভাবে চোরাই পথে চলে যাচ্ছে এই মূল্যবান সম্পদ।  তবে সরকার কি চাইলে পারেনা এই অবৈধ সংযোগ গুলো বৈধ করে সেই অর্থ দিয়ে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ ত্বরান্বিত করতে? গ্যাস ব্যবস্থাকে আরো দূর্ঘটনামুক্ত করতে? অতীতে অবৈধভাবে শুধু চুলা জ্বল্লেও বর্তমানে আর সেই অবস্থায় নেই। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পথ পাইপের মাধ্যমে গ্যাস চুরি হচ্ছে।  এমন অনেক এলাকাই আছে যেখানে তিতাস কর্তৃপক্ষ গ্যাস সংযোগই দেয়নি। কর্তৃপক্ষ  সকালে গ্যাস লাইন বিচ্ছিন্ন করলে বিকেলেই আবার সংযোগ দিয়ে দিচ্ছে স্থানীয়রা। এভাবে লাখে লাখে সংযোগ চলছে অবৈধভাবে।  অপরিকল্পিত সংযোগের ফলে কিছুদিন পর পর ঘটছে বড় বড় দুর্ঘটনা। গত  ৬ তারিখ নারায়ণগঞ্জে মসজিদে আগুন লাগার ঘটনা আমাদের কারোরই অজানা নয়। ২৬জনের বেশি প্রাণ হারাতে হয়েছে এই দুর্ঘটনায়। স্থানীয়দের মতে মসজিদের নিচ দিয়ে গ্যাসের লাইন ছিদ্র  থাকায় অনেক গ্যাস জমা হয় পরে তা বিদ্যুৎ এর আগুন লেগে বিস্ফোরণে রুপ নেয়। যদিও প্রথমে শুনা গিয়েছে এসি থেকে এই বিস্ফোরণ ঘটে। কিন্তু পরে এই বিষয়টি ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছে বিবিসি বাংলাকে। এর আগেও আমরা চকবাজারের ট্রাজেডির কথা ভুলিনি। সবি হচ্ছে আমাদের অবহেলা আর অসতর্কতা,অপরিকল্পিত সংযোগের কারণে। তা সত্বেও গ্যাস সংযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে এবং গ্যাসের লাইন টানার ক্ষেত্রে চলছে অবহেলা।  তিতাস কর্তৃপক্ষ বলেছে যে, স্কাডা হলো এমন এক গ্যাস বিতরণ ব্যবস্থা যেখানে শুধু অপচয় নয় বরং এক লাইন থেকে অন্য লাইনে কেউ গ্যাস সংযোগ দিলেও তা নির্ণয় করা সম্ভব। সেটা কেন্দ্র থেকেই নজরদারি করা যাবে।  প্রশ্ন হলো যদি তাই সম্ভব হয় সেটির প্রয়োগ কেন হচ্ছে না? নাকি তারা ইচ্ছে করেই তা চাচ্ছে না? এই পদ্ধতি প্রয়োগ করলে কি তাদের দূর্নীতির শেকড় ভেস্তে যাবে? এর প্রয়োগ কি আদৌও কোথাও হয়েছে??



অপরদিকে গ্যাস চুরি হওয়ার সাথে গ্যাসের অপচয় কোনোভাবেই কমছেনা। বিদ্যুৎ এর মত নির্দিষ্ট পরিমাপক যন্ত্র নেই বলে মাসিক নির্দিষ্ট টাকায় ইচ্ছে মত গ্যাস ব্যবহারের সাথে সাথে চুরি এবং অপব্যবহার ও চলছে ব্যাপকহারে। গ্যাসের চুলা জ্বালাতে কাঠি খরচ হবে বলে চুলা বন্ধ না করে জ্বালিয়ে রাখছে সবসময়। আবার কেউ বা কাপড় শুকাচ্ছে গ্যাসে চুলা জ্বালিয়ে। এর ফলে দূর্ঘটনাও হচ্ছে ব্যাপক। রাস্তায় বৃষ্টি পরে পানি জমলে তখন প্রায়শই দেখা যায় পানি থেকে ফুটফুট করে কি যেন বের হচ্ছে।  এমন দেখা যায় রাস্তার নামায়, পুকুরের পাশ দিয়ে ঘেঁষে যাওয়া গ্যাসের পাইপের লাইন থেকে ছিদ্র হয়ে বা সংযোগ বিচ্ছিন্ন কিংবা ভালো করে সংযোগ না দেয়াতে।
এগুলো কি অপচয় নয়? এর ফলে কি দূর্ঘটনার স্বীকার হচ্ছিনা আমরা?


 বিবিসি বাংলার এক সাক্ষাৎকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে মজুতকৃত গ্যাসের পরিমান ১২ টিসিএফ। প্রতিবছর খরচ হচ্ছে এক টিসিএফ। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে বাংলাদেশের মজুতকৃত গ্যাস আর কত বছরের মধ্যে শেষ হবে। তবে  বিশেষজ্ঞরা মনে করেন বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় পর্যাপ্ত গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মিনিস্ট্রি অফ পাওয়ার এনার্জি এন্ড মিনারেল রিসোর্স এর মতে,বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় মোট ২৮টি খনিজ ও গ্যাসের  ব্লক রয়েছে।  এর মধ্যে ১৩ টি রয়েছে গভীর সমুদ্রে এবং বাকি ১৩ টি ব্লক রয়েছে অগভীর সমুদ্রে।  বাংলাদেশ, মিয়ানমারের এবং ভারতের  সাথে সমুদ্রসীমা নিশ্চিত করার পর পরই মিয়ানমার তাদের সমুদ্রসীমায় গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ তড়িৎগতিতে শুরু করে দেয়। তার কিছুদিনের মাথায় তারা সাফল্য খুজে পেয়ে গেলেও বাংলাদেশ  তখনো ঘুমের ঘোরে।    তবে মিয়ানমারের পর ভারতের সাথে সমুদ্র সীমা নিশ্চিত হওয়ার পর বাংলাদেশ খুজে পায় এক নতুন দিগন্ত।  শুধু ভারত যেই ব্লকগুলো তাদের বলে দাবি করেছিলো সেগুলোতেই ২০ ট্রিলিয়ন গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তবে তা যাইহোক,সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও  বাংলাদেশের গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ যেন স্থবির হয়েই আছে ।  ভারত যেখানে বছরে ১০০ টির মত গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য নতুন কূপ খননের টার্গেট নেয় বাংলাদেশ সেখানে নিতান্তই সাদামাটা। ভারতের  রাষ্ট্রীয় গ্যাস অনুসন্ধানকারী সংস্থা ওএনজিসি ২০০ কোটি টাকার বাজেটে  বঙপোসাগরে তাদের অংশে ৪টি ব্লকে অনুসন্ধান চালিয়ে ১৫ ট্রিলিয়ন ঘন ফুট গ্যাস আবিস্কারের সন্ধান পায়। যা বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত মজুত হওয়া গ্যাসের সমান। আবার মিয়ানমার বাংলাদেশের সাথে মীমাংসার পর পরই তাদের সমুদ্র সীমায়  ৬ ট্রিলিয়ন গ্যাসের সন্ধান পায়। তবে এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও  বাংলাদেশ  কেন পিছিয়ে ? বিদ্যুৎ সেক্টরে তো এমন নয়। তবে এই সেক্টরে কেন এত অবহেলা? চকবাজারের ট্রাজেডির পর যখন নারায়ণগঞ্জে গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে তখন সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে যে অবৈধ গ্যাস সংযোগ ২ মাসের মাথায় বিচ্ছিন্ন করবে। তবে  যখনি এমন কিছু দূর্ঘটনা ঘটে তখন সবাই এটা নিয়ে মাতামাতি করলেও ঠিক যেন আবার স্বভাবসুলভ স্থবির হয়ে যায় এই পদক্ষেপ গুলো। সরকার কিংবা কোম্পানি গুলোর অবহেলার কারণে হচ্ছে ব্যপক চুরি, অপচয়, ক্ষয়ক্ষতি এবং বড় বড় দূর্ঘটনা।  এসব কি চাইলে  সরকার সমাধানের দিকে নিতে পারেনা? বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় এত সম্ভাবনা থাকা সত্বেও কেন অনুসন্ধানের কাজ ত্বরান্বিত হচ্ছেনা?
কেন অবৈধ গ্যাস সংযোগ বন্ধ করছেনা কর্তৃপক্ষ? দূর্ঘটনা এড়াতে কেন কার্যকরী এবং দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছেনা? আর কত দূর্ঘটনা ঘটলে কত গ্যাস সম্পদ অপচয় হলে
আমাদের টনকনড়বে?



লিখাঃ মুহাঃ মুহিব্বুল্লাহ
শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

Post a Comment

Previous Post Next Post